দীর্ঘ ২০ বছর পর কাতার বিশ্বকাপে ফের গ্রুপ পর্বের বাধা পেরিয়েছে আফ্রিকার দেশ সেনেগাল। ২০০২ সালে দক্ষিণ কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল দ্য লায়ন অব তেরাঙ্গারা। সে আসরে দলের অধিনায়কত্ব করা আলিউ সিসে এবার কোচ হিসেবে দলকে পার করলেন গ্রুপ পর্বের গণ্ডি। ইতিহাসের ভিলেন থেকে সেনেগালিজ রূপকথার নায়কে পরিণত হওয়া আলিউ সিসে কাতার বিশ্বকাপের অন্যতম আলোচিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন।

এরপর ২০০২ বিশ্বকাপে তার নেতৃত্বেই খেলতে যায় সেনেগাল। প্রথম ম্যাচেই প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। সে ম্যাচে মধ্যমাঠের সঙ্গী পাপে বুবা বিউপের একমাত্র গোলে ফ্রান্সকে হারিয়ে বড় অঘটনের জন্ম দেয় সেনেগাল। এরপর ডেনমার্ক ও উরুগুয়ের বিপক্ষে ড্র করে প্রথমবার খেলতে এসেই পা রাখে নকআউট পর্বে। শেষ ষোলোতেও চলে তেরাঙ্গার সিংহদের ইতিহাস রচনা। সুইডেনকে ২-১ ব্যবধানে হারিয়ে পা রাখে কোয়ার্টার ফাইনালে। সেখানে অবশ্য তুরস্কের কাছে অতিরিক্ত সময়ের গোলে হেরে থেমে যায় সেনেগালিজ রূপকথা।
বিশ্বকাপে দলকে কোয়ার্টার ফাইনালে তুলে সিসে-হাজি দিউপরা তখন জাতীয় নায়ক। এর মধ্যেই ২০০৫ সালে জাতীয় দল থেকে নেন অবসর। কিন্তু সিসেকে তখনো পোড়ায় আফকনের ফাইনালে মিস করা পেনাল্টিটা। কিন্তু দীর্ঘ ২০টা বছর এই যন্ত্রণায় পুড়তে হয়েছে তাকে। এ সময়ের মধ্যে জীবনে এসেছে বড় ঝড়। দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন পরিবারের সদস্যদের। কিন্তু ফুটবলকে ছাড়তে পারেননি। ছাড়তে পারেননি সেনেগাল দলটাকে।
২০১৫ সালে ফের সেনেগাল দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন তিনি। এবার খেলোয়াড় নন, বরং কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেন নিজেদের হারিয়ে খোঁজা লায়ন অব তেরাঙ্গার। টানা তিনটি বিশ্বকাপে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হয়েছে সেনেগাল। পার হতে পারেনি আফকনের গ্রুপ পর্বের গণ্ডিও। নামতে নামতে নিজেদের ইতিহাসের বাজেতম র্যাংকিংয়ে নেমে এসেছে সেনেগাল। সিসে দায়িত্ব নিয়ে ফের দলটাকে ফেরাতে থাকেন কক্ষপথে। ‘
২০১৮তে দীর্ঘ ১৬ বছর পর বিশ্বকাপে জায়গা করে নেয় সেনেগাল। ভালো পারফর্ম করে স্বপ্ন দেখছিল নকআউট পর্বে খেলার। কিন্তু ফিফার অদ্ভুত টাইব্রেকার নিয়মে বাদ পড়ে যায় সেনেগাল। সমান পয়েন্ট ও গোলব্যবধান হওয়ার পরও পরের পর্বের টিকিট পায় জাপান।
২০১৯ সালে আফকনের ফাইনালে ওঠে সেনেগাল। ২০০২ সালের পর যেটা তাদের প্রথম ফাইনাল। সিসের সামনে তখন ইতিহাসের দায়মোচনের সুযোগ। খেলোয়াড়ি জীবনে যা পারেননি কোচ হিসেবে তা করে দেখানোর সুযোগ তার সামনে। কিন্তু ফাইনালে আলজেরিয়ার বিপক্ষে ১-০ গোলে হেরে ফের ব্যর্থ হতে হয় সিসেকে।
বড় কিছু পেতে হলে বারবার ব্যর্থতার পথ মাড়াতে হয় হয়ত। রবার্ট ব্রুস হোক আর সিসে। চোয়ালবদ্ধ দৃঢ়তার সঙ্গে চেষ্টা করে না গেলে সাফল্য ধরা দেয় না কাউকেই। হারের হতাশাকে পেছনে ফেলে সিসে ফের স্বপ্ন দেখতে থাকেন পরের আসরের জন্য। এরই মধ্যে পৃথিবীর বুকে আসে মহামারি। জীবন-মৃত্যুর সংগ্রামে পিছিয়ে যায় ২০২১ সালের আফকন আসর। ২০২২ সালের ফেব্রুয়রিতে অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলে তবেই মাঠে গড়ায় খেলা। দারুণ খেলে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে সিসের দল।
২০১৯ সালে ব্যর্থ হলেও ২২ -এ এসে আর ব্যর্থতা ছুঁতে পারেনি সিসের দলকে। ফাইনালে টাইব্রেকারে মিসরকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো আফ্রিকা সেরা হয় সেনেগাল। ২০ বছর আগে পেনাল্টি মিস করে যে স্বপ্নের জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন অধিনায়ক সিসে, অবশেষে টাইব্রেকারেই তা ধরা দিল কোচ সিসের হাতে। আলিউ সিসে; সেনেগালের ফুটবল ইতিহাসে যার নাম পাতায় পাতায়। কখনো খলনায়ক তো কখনো রূপকথার নায়ক। তেরাঙ্গার লায়ন তিনি, আফ্রিকার স্বপ্নসারথি। তিনি থামতে চান না, স্বপ্ন দেখে যেতে চান।